নন্দী টিভি ডেস্ক: কুমিল্লায় অবাধে মাটি কেটে ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে একসময়ের খরস্রোতা গোমতী নদী ও চর। শীত আসার পর পরই দুপাশের বাঁধ কেটে ওঠানামা করছে শত শত ট্রাক্টর। রাতদিন মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচলে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে নদীর দুপারের বাসিন্দারা। ধুলায় বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। নদীর ভেতরের মাটি কাটার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বাঁধ, সড়ক ও বেশ কিছু সেতু। এই চরের মাটি জেলার অর্ধ শতাধিক ইটভাটায় নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে গোমতী চরের মাটি কাটার প্রতিরোধে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে ভুক্তভোগী শত শত ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক। তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্বারকলিপিও প্রদান করেন।
জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসূত্রে জানা গেছে, গোমতীর উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে। এই নদীটি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজার এলাকা দিয়ে। পরে জেলার আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস ও দাউদকান্দি উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় গিয়ে মিশেছে। বাংলাদেশ অংশে এ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার। নদীর ডান তীরে ৪১ কিলোমিটার ও বাম তীরে ৩৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার বন্যা ব্যবস্থাপনা বাঁধ রয়েছে।
রবিবার (২৬জানুয়ারি) রাত ৮টার পর দেবিদ্বার উপজেলার অংশের খলিলপুর, বিনাইপাড়, চরবাকর, বড় আলমপুর, চান্দপুর, লক্ষীপুর, কালিকাপুর-নয়াপাড়া এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শত শত ট্রাক্টর ছুটছে নদীর চরের দিকে, নদীর দুই পাশে লাগামহীনভাবে কেটে নেওয়া হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। রাতে ট্রাক্টরের শব্দ আর ধুলোয় অতিষ্ঠ গোমতীর পাড়ের মানুষ। তবে এসব এলাকায় দিনের বেলায় কাউকে মাটি কাটতে দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার আদর্শ সদর, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, তিতাস অংশে অর্ধশতাধিক সিন্ডিকেট চক্র চরের সহজ-সরল কৃষকদের ফাঁদে ফেলে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য করছে। তারা চরের জমির মাটি কিনে ২০ থেকে ৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি কাটে। পাশের জমি নিচে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ওই সিন্ডিকেট পাশ্ববর্তী জমির মালিককেও বাধ্য করেন মাটি বিক্রি করতে। নিরুপায়ে হয়ে নামমূল্যে মাটি বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষকরা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার টিক্কাচর, ছত্রখীল, পালপাড়া, দুর্গাপুর, আমতলী, কাচিয়াতলী, বুড়িচং এর বাবুবাজার, বাজেবাহেরচর, পূর্বহুরাসহ আশ পাশের এলাকায় দেখা গেছে একই চিত্র। এসব এলাকায় বর্তমানে ফসল উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
এই চক্রের মূলহোতাদের মধ্যে রয়েছে, দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ এলাকার আওয়ামীলীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম, কালিকাপুর-নয়াপাড়া এলাকার শিষন মিয়া ও দুলাল মিয়া। তারা রাতের আঁধারে মাটি কেটে ছুগুরা গ্রামের লিমা ব্রিকস ও কালিকাপুরের এমএমবি ব্রিকসে নিয়ে যায়। একটি চক্র রাতে রাস্তায় বসে ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের পাহারা দেন বলেও জানা গেছে। কুমিল্লা আর্দশ সদর এলাকা, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়ায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র। এসব উপজেলার প্রায় শতাধিক ইটভাটায় গোমতীর চরের মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে।
দেবিদ্বার উপজেলার বড়আলমপুর গ্রামের (অব.) সার্জেন্ট নাছির বলেন, এক সময়ে এই চরে বিঘার পর বিঘায় চাষবাস হতো। বর্তমানে ফসল শূন্যে পুরো চর খাঁ খাঁ করছে। কয়েকদিন পর পর অভিযানে দুই একজন শ্রমিক আটক হলেও যারা মূল হোতা তারা ধরে পড়ে না। তারা ধরাছোয়ার বাহিরে থেকে এসব পরিচালনা করে।
আর্দশ সদর উপজেলার টিক্কারচর এলাকার কৃষক মো.সিরাজুল ইসলাম ও আবু হানিফ, দেবিদ্বারের চরবাকর গ্রামের মনু মিয়া, খলিলপুর গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন ও শরিফুল ইসলাম বলেন, রাতে মাটি কাটা শুরু হয়, চলে ভোর পর্যন্ত। এই চরে সবজি ফলিয়ে রুটি রুজি করত এই এলাকার কৃষকরা, আজ তারা পথে বসেছে। জোর করে মাটি কেটে নিচ্ছে, বাঁধা দিলে মারধর করে। আগে আওয়ামীলীগের লোকেরা কাটত এখন বিএনপির লোকেরা কাটে। গেল বন্যায় পানি উঠে চরের ভিতরে বাড়িঘর ডুবে যায়, তখন নিরুপায়ে হয়ে বাধেঁর উপর আশ্রয় নেয় তারা। রাত দিন বেঁড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নেয়, শত শত মানুষের আহাজারি কান্না দেখেছে সারা দেশ। কয়েকমাস আগের বন্যায় গোমতী বেঁড়িবাঁধের অনেক স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। হাজার হাজার মানুষ বস্তায় মাটি ভরে রাতদিন বেঁড়িবাঁধের ভাঙনস্থানে সংস্কার করেছে। পরে ২২ আগষ্ট রাত ১০টার দিকে বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় বেঁড়িবাঁধ ভাঙন দেখা দেয়। এতে কুমিল্লার ৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়। এত কিছুর পরও মাটি সিন্ডিকেটকে থামানো যাচ্ছে না। তারা শীত আসলেই মাটি কাটা শুরু করে।
এই ব্যাপারে মাটি সিন্ডিকের মূলহোতা জাফরগঞ্জের সিরাজুল ইসলামের মুঠো ফোনে কল করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর এখন ঘুমাচ্ছেন বলে লাইন কেটে দেন। পরে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা শাখার সভাপতি ডা: মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ভূমিখেকোরা এখন অভিনব কায়দায় রাতে মাটি কাটছে , রাতে তো আর ম্যাজিস্ট্রেট যায় না। এটি যদি জেলা প্রশাসন বন্ধ না করতে পারে তাহলে কুমিল্লার ভবিষ্যত খুব খারাপ পর্যায়ে পৌছাবে। কুমিল্লার টিক্কারচর একটি ফসলি আবাদ ভূমি এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে নানা সবজি চাষ হতো এখন আর কিছুই হচ্ছে না। এভাবে নদী যে যে এলাকায় দিয়ে গেছে সে সে এলাকায় মাটি কাটছে, এখন মূল নদী কোনটা বা কোন দিকে স্রোত কোন দিকে যাচ্ছে তা বুঝা যাচ্ছে না।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবদুল লতিফ বলেন, নদী হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি, নদী থেকে বালু বা মাটি উত্তোলন এটি জেলা প্রশাসক বা স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারেন এটি তাদের এখতিয়ার। আমাদের হলো গোমতীর বেঁড়িবাঁধ রক্ষার দায়িত্ব। যদি কেউ বেঁড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করি। এখনও অনেক মামলা চলমান রয়েছে।
এই ব্যাপারে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো.আমিরুল কায়ছার বলেন, গোমতী চরের মাটি কাটার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে দেখতেছি।


