স্থানীয় নির্বাচন নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে হবে এই প্রশ্নে সংস্কারের আলোচনা চাপা পড়েছে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। আলোচকদের একটা অংশ জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার স্বার্থে স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়া উচিত বলে মত দেন। তাদের অনেকে সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনের পক্ষে মত দেন।
শনিবার (৮ মার্চ) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে সেন্ট্রাল ফর পলিসি এনালাইসিস অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি (সিপিএএ) আয়োজিত বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিষয়ক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেছেন।
সংলাপে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সিপিএএ’র মডারেটর ও অবসরপ্রাপ্ত সচিব অধ্যাপক ড. মো. শরিফুল আলম।
আলোচনায় অংশ নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ভেবেছিলাম অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে। কিন্তু তা হয়নি। ভদ্র লোকের রাষ্ট্র আমরা চাই না। আগে জাতীয় না স্থানীয় নির্বাচন তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমরা রাষ্ট্রকে কোথায় নিতে চাই। আমরা কি ভদ্রলোকের রাষ্ট্র চাই নাকি সকলের রাষ্ট্র চাই, এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনৈতিক দল ও অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে কোনো কমিশন হয়নি। অথচ এটা সবচেয়ে জরুরি ছিল।
এই বিতর্কের কারণ প্রসঙ্গে সোহরাব হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যত অনির্বাচিত সরকার এসেছে, তারা সবাই আগে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা কাঠামো তৈরি করেছে। এরপর নতুন দল করে জাতীয় নির্বাচন দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এই ভয়টা পাচ্ছে। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাস করছে না। আবার রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে বিশ্বাস করছে না। এই আস্থার সংকট দূর করতে হবে। নতুনদের প্রমাণ করতে হবে যে, তারা পুরাতনদের থেকে ভিন্ন।
এবি পার্টির নেতা ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, নির্বাচনী আলোচনাটা সংস্কার ও বিচারকে পাশ কাটিয়ে পুশ করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর যে দখল ও লুটপাটের দোষে দূষিত, নতুনরা কি সেই কয়লা গায়ে মাখেনি? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের মধ্যে থাকতে হবে। নির্বাচনের আগে এর কাঠামো ঠিক করতে হবে।
ব্যারিস্টার ফুয়াদ বলেন, আওয়ামী লীগ মাঠে নেই, তাই একটি দলের টিকিট পাওয়ার মানেই নির্বাচিত হয়ে যাওয়া। তাই মনোনয়ন নিয়ে মারপিট হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান সংস্কারের কথা বললেও দলের মধ্যে সংস্কারের উদ্যোগ নেই। যাদের নিজের দলে গণতন্ত্র নেই, নেতাকর্মীরা লুটপাটে যুক্ত তারা দেশের কী সংস্কার করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাই বলছেন তারা আসলে কোনো সংস্কার করতে পারবে না।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. আবদুল কাইয়ূম বলেন, জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করা দরকার। স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে না পারলে জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু করা যাবে না। জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার স্বার্থে স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়া উচিত।
আবদুল কাইয়ুম আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রশাসনিক যে সমস্যা দেখা দিয়েছে, অতীতে কিন্তু এমন সমস্যা দেখা দেয়নি। পুলিশকে এখন আর কার্যকরী প্রতিষ্ঠান বলা যায় না। সাধারণ প্রশাসন যারা নির্বাচনের মূল ভূমিকা পালন করবে, তারা যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে এটা আশা করা যায় না।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদী বলেন, আমরা আগে বলেছি সংস্কার প্রয়োজন। এরপর বলেছি নির্বাচনের কথা। বর্তমানে ছাত্রদের যে রাজনৈতিক দল রয়েছে তারাও এখন আর সংস্কারের কথা বলে না। আমাদের ছাত্রদের দলও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কিছু সিটের রাজনীতি করছে।
শরিফ ওসমান বলেন, পলিটিক্যাল কালচার পরিবর্তন জরুরি। ড. ইউনূসের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে চাই, কোন কোন রাজনৈতিক দল কোন কোন সংস্কারের বিরোধী তা ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া উচিত। যেন শত বছর পরেও মানুষ জানতে পারে, কারা বিপ্লবের সুযোগ নষ্ট করেছিল।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, এই সরকারেরও সময় শেষ হয়ে আসছে। ডিসেম্বরে তারা নাকি নির্বাচন দেবে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ কোনো সংস্কার আসেনি। কিন্তু, তারাই তো ইলেকশন করবে। নতুন পার্টি যেটা গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যেও কোনো পরিবর্তন দেখিনি। আমরা শুনছি, নতুন পার্টিও চাঁদাবাজি করছে। রোজগারের ব্যবস্থা যে সিস্টেমের ছিল, সেভাবেই চলছে। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়া উচিত। আগে হলে অনেক উপকার হবে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, বর্তমান সরকারের কাছে একটা দ্বৈততা এসে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ছাত্রদের যে দল রয়েছে সেটি মানুষকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকে নিক্ষিপ্ত করেছে।


