মোহাম্মদ নাজমুল হাসান:
আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। টুয়েলভথ ফেল সিনেমার মতো এতোটা সংগ্রাম না করতে হলেও আমাদের জীবন অনেকটা সেরকমই। একটু আছে, একটুর অভাব। সংগ্রামময় জীবন। চলছে, চলবে।
এ নিয়ে অবশ্য কোনো পরিতাপ নেই। বরং নিজের যোগ্যতায় মাথা উঁচু করে চলার সামর্থ্য আমার কাছে গর্বের। আমি সংগ্রামী মানুষদের, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষদের অধিকতর সম্মান করি।সভ্যতা, সংস্কৃতি আর মুল্যবোধ এরাই গড়ে দেয়। আর এর পেছনে বড় কারণ সুশিক্ষা আর বিবেকবোধ। শিক্ষা শুধু জীবিকাই দেয় না, উন্মেষ ঘটায় মনুষ্যত্ববোধের আর আলো ছড়ায় পুরো পৃথিবীতে।
ছাত্র হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলাম না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স অ্যাপিয়ার্ড সার্টিফিকেট দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষা দেয়া শুরু। আমার মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ যখন আবেদন করা প্রায় সবগুলো পরীক্ষায় মেধা তালিকায় থাকে তখন বিশ্বাস জন্মে যে এখানে নায্যতা আছে। পড়াশুনার মূল্যায়ন আছে। তখন দেশের প্রতি আরো নিবেদন বাড়ে। আমিসহ আমার আশেপাশে এমন অনেক বন্ধু/পরিচিতদের চাকুরি হয়েছে বিনা পয়সায় এবং শুধুমাত্র মেধার জোরে। এই ব্যাপারগুলো পজিটিভ এনার্জি তৈরি করে। তরুণদের জীবন সম্পর্কে, সিস্টেম সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা দেয়। দেশকে, মাটিকে ও মানুষকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করে।
গত ১০/১৫ বছরে প্রায় নিয়মিত এবং স্বচ্ছ নিয়োগের ফলে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। মেধাবীরা আসছে। কৌশলগত কারণেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রায় শতভাগ স্বচ্ছ বলে জেনেছি। কিন্তু সম্প্রতি যখন জানলাম আমাদের অনেকের আস্থার জায়গা পিএসসির কিছু কিছু পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। তখন অবাক হয়েছি এবং একই সাথে হতাশ হয়েছি। যারা বিশ্বাস করে যে, নিবেদন আর পরিশ্রম থাকলে মিরাকল হয় তারা অসহায়বোধ করছে। যারা অনেক সংগ্রাম করে জীবনযুদ্ধে বড় হবার স্বপ্ন দেখে; তাঁদের স্বপ্নের পথ রুদ্ধ করেছে কিছু লোভী দুর্নীতিবাজ।
সকল দুর্নীতিই জঘন্য অপরাধ। আর নিয়োগ পরীক্ষা সংক্রান্ত দুর্নীতি আরেক কাঠি সরেস। যার রেশ থেকে যায় বহু যুগ। কারণ অসদুপায় অবলম্বন করে যে চাকরি পায় সে নিশ্চিত সারা জীবন অন্যায় আর দুর্নীতি করেই যাবে। আমার ধারনা বিসিএস এর মতো সিস্টেমেটিক পরীক্ষায় দুর্নীতি করে নিয়োগপ্রাপ্তদের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়। তবু এদের চিহ্নিত করা অপরিহার্য।
প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত এবং যারা অসদুপায় অবলম্বন করে ক্যাডার/নন ক্যাডার হয়েছে সকলকে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে সবার তালিকা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হোক! এমন অমানুষ ও অযোগ্যদের নিয়োগের কারণে রাষ্ট্র, সমাজ ও অগণিত মানুষ দীর্ঘদিন যাবৎ বঞ্চিত হয়।
যে ছেলেটা প্রতিকূলতা ঠেলে দুর্দান্ত প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে, অন্যান্য চাকরি ছেড়ে যে মেয়েটা নিজের মেধার জোরে ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করল তাঁরা কেন এই নোংরামির কারণে অস্বস্তিতে পড়বে? প্রকৃত মেধাবী ও সৎ মানুষদের কেন এই নোংরামি স্পর্শ করবে?
পরিতাপের বিষয়, সম্মানিত মানুষকে অপমানিত হতে দেখার মতো সুখ আর নেই। পরশ্রীকাতরতা ও তীব্র শ্রেণি চেতনার কারণে এমনি অনেকে ভালো কিছু সহ্য করতে পারে না। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে আমরা কখনো কখনো অন্যের শক্তির নিন্দা করি। এই বিশেষ সময়ে কেউ কেউ ঢালাওভাবে পুরো বিসিএস নিয়েই নেতিবাচক কথা বলছে। নিজের দুর্বলতাকে এই সুযোগে জাস্টিফাইও করে নিচ্ছে কেউ কেউ।
বিভিন্ন শ্রেণি পেশায় খারাপ মানুষ আছে, দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ আছে।তবে সবাই খারাপ হয়ে যায়নি। শুভবোধ এখনো বেঁচে আছে। আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, হচ্ছে। এখন খুব দরকার আত্মিক উন্নয়ন। আশা করছি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আলোচ্য সবকিছুর সুষ্ঠু তদন্ত হবে। নির্মোহভাবে শুদ্ধি অভিযান হবে সকল দুর্নীতি, অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
পরিশ্রম ও মেধার পরাজয় হয় না। প্রজন্ম যেন আশাহত না হয়। প্রচুর পড়তে হবে। একটাই জীবন। হার মানা যাবে না। স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা যাবে না।
লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কুমিল্লা